শিবিরে গণপদত্যাগ, দায়ী করা হচ্ছে মুজাহিদ-রেজাউলকে

অন্তঃকোন্দলে পুড়ছে ইসলামী ছাত্রশিবির। সংগঠনটির ৩২ বছরের ইতিহাসে কার্যকরী পরিষদের সদস্যদের গণপদত্যাগের এমন ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটল। সংগঠনের প্রতি চরম দায়বদ্ধ শিবিরের নেতারা সাধারণত কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বাইরে যান না। কিন্তু এবার কার্যকরী পরিষদের ২৬ সদস্য একযোগে পদত্যাগ করলেন। এ ছাড়া সারা দেশে আরও ১৯৪ জন শিবির সদস্য (সর্বোচ্চ পদ) গত দুই দিনে পদত্যাগ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে চরম বিব্রত জামায়াত ও শিবিরের নেতারা।
পদত্যাগী একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, গণপদত্যাগের একটি কারণ বর্তমান সভাপতির স্বেচ্ছাচারিতা। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক কর্মীকে হত্যার ঘটনায় শিবিরের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি কার্যকরী পরিষদের অধিকাংশ নেতা। এমনকি বিষয়টি তাঁরা জানতেনই না। তাঁদের অভিযোগ, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পরামর্শে শিবিরের বর্তমান সভাপতি রেজাউল করিম এ ঘটনার সঙ্গে জড়ান। মুজাহিদসহ জামায়াতের কয়েকজন নেতা শিবিরকে সাম্প্রতিক সময়ে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছিলেন বলেও তাঁরা অভিযোগ করেন।
শিবিরের নেতাদের গণপদত্যাগের বিষয়ে গতকাল জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে তাঁর কোনো মন্তব্য নেই। এ বিষয়ে কথা বলতে আলী আহসান মুজাহিদের ফোনে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, তিনি সভায় আছেন। কথা বলতে পারবেন না।
ছাত্রশিবিরের পদত্যাগী সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেভাবে চেয়েছিলাম সেভাবে সংগঠন চলছিল না বলেই আমি ব্যক্তিগতভাবে পদত্যাগ করেছি। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত কারণ। কিন্তু অন্যরা কেন পদত্যাগ করল, তা আমার জানা নেই।’
ছাত্রশিবিরের কার্যকরী পরিষদের মোট সদস্য ৪১। এর মধ্যে ২৬ জনই পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ এই সদস্যরা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সভাপতিকে ইমপিচ (অভিশংসন) না করে কেন একযোগে পদত্যাগ করলেন? বিষয়টি সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে পদত্যাগী তিন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা জামায়াতের নেতাদের বিষয়টি জানিয়েছিলেন; কিন্তু নেতারা তা শোনেননি। বাধ্য হয়ে তাঁরা সরে গেছেন।
আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, গত ২১ জানুয়ারি পদত্যাগ করেন তিনি। কিন্তু বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। কারণ তখন পত্রটি কেন্দ্রীয় কমিটি গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। তবে সোমবার রাতে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়। মামুনের পদত্যাগের পর অন্য ২৫ জন পদত্যাগ করেন।
একটি সূত্র নিশ্চিত করে বলেছে, ৪১ জনের মধ্যে বর্তমানে ঢাকা মহানগরের দুজন, বরিশালের একজন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনসহ মোট ছয়জন বাদে বাকি সবাই পদত্যাগ করেছেন। তবে এরই মধ্যে পদত্যাগী নেতাদের স্থলে অন্যদের নির্বাচিত করা হয়েছে। এখন সাধারণ সম্পাদক ঠিক করা হচ্ছে। সেটি হয়ে গেলেই নতুন কমিটির কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়েই পদত্যাগ করেছেন কি না—জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সভাপতি শামসুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম থেকে সেটি বলব না। তবে সংগঠনে সমস্যা ছিল বলেই পদত্যাগ করেছি। কিন্তু সংগঠনের প্রতি আমাদের ভালোবাসা কারও চেয়ে কম নয়।’
পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের তিন শীর্ষ নেতার সঙ্গে গতকাল কথা হয়। তাঁরা জানান, বর্তমান সভাপতি রেজাউল করিম শিবিরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শিশির মুহাম্মদ মুনিরকে একক সিদ্ধান্তে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেন। তখন থেকেই কার্যকরী পরিষদের নেতারা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এ ছাড়া গঠনতন্ত্র ভেঙে একক সিদ্ধান্তে তিনি কার্যকরী পরিষদের এক-তৃতীয়াংশ সদস্য মনোনয়ন দেন। এ নিয়েও অসন্তোষ ছিল।
একাধিক নেতা জানান, রেজাউলের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ শুরু হয় গত বছরের শেষ থেকেই। কার্যকরী পরিষদ তাঁকে এসব বিষয়ে প্রশ্ন করলেও তিনি কোনো সদুত্তর দেননি। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। কমিটি তদন্ত করে বিভিন্ন অভিযোগের সত্যতা পায়। কমিটি রেজাউলকে একাধিকবার ডাকলেও তিনি যাননি।
শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নেতা বলেন, নিজের সমস্যা বুঝতে পেরে রেজাউল জামায়াতের নেতা মুজাহিদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর মুজাহিদের পরামর্শে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মামুনকে কার্যকরী পরিষদের বৈঠক ডাকার নির্দেশ দেন রেজাউল। কিন্তু মামুন সেটি করতে রাজি হননি। এ ঘটনার পর রেজাউল সাধারণ সম্পাদক মামুনকে বলেন, ‘আপনার আর সংগঠনের দায়িত্ব পালনের দরকার নেই।’
পদত্যাগী নেতারা জানান, এ পরিস্থিতিতে সোমবার বিকেল চারটায় মামুনসহ ২৫ নেতা নিজামীর সঙ্গে দেখা করতে যান। কিন্তু রাত আটটা পর্যন্ত তাঁদের বসিয়ে রাখা হয়। এরপর নিজামী এসে তাঁদের বলেন, ‘আপনারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। রেজাউল যা করছে, সেটাই ঠিক। আপনারা মুজাহিদসহ জামায়াতের বড় বড় লিডারদের গ্রেপ্তারের জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।’
ঘটনাস্থলে উপস্থিত শিবিরের এক নেতা জানান, এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকরী পরিষদের নেতারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এর পরই তাঁরা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।
সার্বিক বিষয় নিয়ে শিবিরের সভাপতি রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে শিবিরের কার্যকরী পরিষদের সম্পাদক দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী প্রথম আলোকে বলেন, একযোগে এভাবে তাঁদের পদত্যাগের বিষয়টি দুঃখজনক। তবে সংগঠন তার গতিতেই চলবে। এখন কার্যকরী পরিষদের জরুরি বৈঠক চলছে। বুধবার বৈঠক শেষ হবে। এরপর নতুন নেতাদের নাম সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হবে।
সভাপতিকে বহিষ্কারের দাবি: ‘সেভ দ্য শিবির’ নামে একটি সমর্থক গোষ্ঠী গত রাতে ই-মেইল পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ইতিমধ্যে কার্যকরী পরিষদের ২৬ নেতা পদত্যাগ করেছেন। এভাবে চললে সারা দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতারা পদত্যাগ করবেন। শিবিরকে বাঁচাতে রেজাউল করিমকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করার দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে আলী আহসান মুজাহিদসহ কয়েকজন জামায়াত নেতার বিচার দাবি করা হয়।
সভাপতির বিবৃতি: গতকাল পাঠানো এক বিবৃতিতে রেজাউল করিম বলেছেন, টেলিভিশনের মাধ্যমে তিনি প্রথম জানতে পারেন, সাধারণ সম্পাদকসহ ২৪ জন পদত্যাগ করেছেন। কেন্দ্রীয় সভাপতির কাছে পদত্যাগপত্র না দিয়ে এভাবে প্রচারমাধ্যমে পরিবেশন করা দুর্ভাগ্যজনক, অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত ও অসাংবিধানিক। আর যাঁরা পদত্যাগ করেছেন, তাঁদের অনেকের ছাত্রজীবন আগেই শেষ হয়েছে। তবে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে কয়েকজন সাংগঠনিক কার্যক্রমে সহযোগিতা করতে শুরু করেছেন।
শরিফুল হাসান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২৪, ২০১০