শিবিরে গণপদত্যাগে জামায়াতে তোলপাড়

আরও ২শ' সংগঠন ছেড়েছেন
আলতাব হোসেন/রাজীব আহাম্মদ
দীর্ঘকাল পর জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির বড় ধরনের অন্তর্কলহে জড়িয়ে পড়েছে। শিবির সভাপতির বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগে অনাস্থা জানিয়ে শিবিরে গণপদত্যাগ অব্যাহত রয়েছে। কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকসহ কার্যকরী পরিষদের ২৪ সদস্য সোমবার পদত্যাগ করেছেন। এদিকে গতকাল মঙ্গলবার শিবিরের বিভিন্ন শাখার ১৯৪ জন সদস্য পদত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে শিবিরের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া পদত্যাগকারীদের অনুসারী আরও অনেকে শিবিরের রাজনীতি থেকে পদত্যাগ করতে পারেন। শিবিরের গণপদত্যাগে অভিভাবক সংগঠন জামায়াতের মধ্যে চলছে তোলপাড়। যদিও এ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না জামায়াতের শীর্ষ নেতারা। শিবিরের ৪১ সদস্যের কার্যকরী পরিষদের ২৪ জন পদত্যাগকারী হলেন_ শিবিরের কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক আহমেদ জায়দুর রহমান, অর্থ সম্পাদক আবদুর জব্বার, প্রচার সম্পাদক গোলাম মাওলা শিমুল, শিক্ষা সম্পাদক যোবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া, আন্তর্জাতিক সম্পাদক এসএ হাসিব, ছাত্র কল্যাণ সম্পাদক গোলাম মর্তুজা, শিশু কল্যাণ সম্পাদক জাকারিয়া পাইলট, বিতর্ক সম্পাদক ডা. ফখরুদ্দিন মানিক, পাঠাগার সম্পাদক আবুল কালাম আযাদ, ঢাবি সভাপতি আনিসুর রহমান, বিজ্ঞান সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার, মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, আইন সম্পাদক আবু সাঈদ খান, সমাজকল্যাণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন, তথ্য সম্পাদক মোহাম্মদ আসাদ উদ্দিন, ঢাকা মহানগর পূর্বের সভাপতি মইন উদ্দীন, ঢাকা মহানগর পশ্চিমের সভাপতি মাকসুদুর রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুল আলম গোলাপ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি মোহাম্মদ জাকির হোসাইন, চট্টগ্রাম মহানগর (উত্তর) মুহাম্মদ কলিমুল্লাহ, চট্টগ্রাম মহানগর (দক্ষিণ) সভাপতি আবদুল জব্বার খান, সিলেট মহানগর সভাপতি শাহরিয়ার আলম সিপার ও ময়মনসিংহ শহর সভাপতি ডা. শহীদুল্লাহ শরীফ। পদত্যাগের পর একদিন পেরিয়ে গেলেও এখনও কোনো সমাধান হয়নি শিবির সমস্যার। গতকাল দফায় দফায় বৈঠক হয় শিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। তবে বৈঠকের কোনো খবর বাইরে প্রকাশ করা হয়নি। চলছে কার্যকরী পরিষদ পুনর্গঠনে
নির্বাচন। নির্বাচন চললেও শিবির কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। জামায়াত-শিবিরের কোনো নেতাই গণমাধ্যমের সামনে মুখ খোলেননি। পদত্যাগের ঘটনায় কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন, 'এটা একান্তই শিবিরের ব্যাপার। শিবিরের কাছে যান।'
শিবির সভাপতির বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিংস ঘটনার পর শিবিরকর্মীদের ওপর পুলিশি নির্যাতন প্রতিরোধে উদ্যোগ না নেওয়া, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদের কর্তৃত্ব মেনে চলাসহ নানা কারণে শিবিরে অসন্তোষ বিরাজ করছিল। আর জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে দ্বন্দ্বের জের ধরে চলছে গণপদত্যাগ। ৩০ বছরের মধ্যে এটিই শিবিরের বড় বিভক্তি। জামায়াতের রাজনীতির প্রধান শক্তিই হচ্ছে ছাত্রশিবির। ইরান বিপ্লবের পর ১৯৮২ সালে আদর্শিক দ্বন্দ্বের জের ধরে শিবিরে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। তখন সভাপতিসহ কার্যকরী কমিটির অর্ধেক সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়। সে সময় শিবিরের বহিষ্কৃত নেতারা 'ভ্রাতৃ শিবির' নামে আলাদা আরেকটি সংগঠন করেন। এটাই ছিল শিবিরে বড় ভাঙন।
শিবির সূত্রে জানা গেছে, পদত্যাগীদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলেও সে চেষ্টা ভেস্তে গেছে। তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে চলছে নতুন কার্যকরী পরিষদ গঠনের প্রক্রিয়া। কমিশনের প্রধান জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক আজির আহমেদ। তবে কমিটির বাকি দুই সদস্যের নাম জানা যায়নি। এর আগে গতকাল রাতেই বিভিন্ন সদস্য শাখার পদত্যাগী সভাপতির পদ পূরণে গোপন ব্যালটে নির্বাচন হয়। তবে নবনির্বাচিত সভাপতিদের নাম এখনও জানা যায়নি। একইসঙ্গে চলছে কার্যকরী পরিষদের নির্বাচন। কার্যকরী পরিষদ গঠনের পরই নির্বাচিত করা হবে নতুন সাধারণ সম্পাদক। তবে বর্তমান সভাপতি রেজাউল করিম নিজ পদে বহাল থাকছেন, তা নিশ্চিত। শিবিরের অভিভাবক সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ রেজাউল করিমকে সমর্থন দিয়ে শিবির পুনর্গঠনে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে গতকাল পদত্যাগ করা অর্থ ও দফতর সম্পাদক যথারীতি শিবির কার্যালয়ে গিয়েছেন। নিজ দফতরের কাজও করেছেন।
যে কারণে বিদ্রোহী হলেন ডা. মামুন
ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি অভিযোগ করেন, বর্তমান সভাপতি রেজাউল করিম ছাত্রশিবিরকে ইসলামী আদর্শিক ছাত্র সংগঠন থেকে তথাকথিত রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করেছেন। মামুনের পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করেন আরও ২৩ কার্যকরী পরিষদ সদস্য। তাদের অভিযোগ, জামায়াত নেতারা শিবিরকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগ না থাকলেও আলী আহসান মুজাহিদ ও নগর জামায়াতের আমির রফিকুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় তাদের।
পদত্যাগী সাধারণ সম্পাদক ডা. আবদুল্লাহ মামুন গত ১৮ জানুয়ারি শিবিরের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। শিবির সভাপতি রেজাউল করিমই তাকে মনোনয়ন দেন। সোমবার মামুন সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তার অভিযোগ, বর্তমান সভাপতি রেজাউল করিম ছাত্রশিবিরকে ইসলামী আদর্শিক ছাত্র সংগঠন থেকে তথাকথিত রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করেছেন। জামায়াত নেতারা শিবিরকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। ডা. মামুনকে সেক্রেটারি করতে গিয়ে রেজাউল করিম একক সিদ্ধান্তে বাদ দেন আগের সাধারণ সম্পাদক শিশির মুহাম্মদ মুনিরকে। এতে ক্ষুব্ধ হন কার্যকরী পরিষদের সদস্যরা। শিবিরের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, শিবির সভাপতি পরিষদের পরামর্শক্রমে সেক্রেটারি মনোনয়ন দেন। এর আগে শিবির সভাপতি একক ক্ষমতাবলে অনেক সদস্যের ছাত্রজীবন শেষ করে দেন। যাদের অনেকেই কার্যকরী পরিষদে আসার যোগ্য ছিলেন। শিবিরের ঐতিহ্য অনুযায়ী, কার্যকরী পরিষদের নির্বাচন সদস্য সম্মেলনের পরপরই সম্পন্ন হয়। কিন্তু সভাপতি রেজাউল করিম নিজের অনুগতদের কার্যকরী পরিষদে ঠাঁই দিতে এখনও পরিষদ নির্বাচন করেননি। যদিও তিনি গতকাল দাবি করেন রাবির ঘটনার পর পুলিশি নির্যাতনের কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালের কার্যকরী পরিষদ দিয়েই চলছিল সাংগঠনিক কাজ। নির্বাচন করা না হলেও কার্যকরী পরিষদে একক ক্ষমতায় আরও সদস্য মনোনয়ন দেন সভাপতি। শিবিরের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সভাপতি কার্যকরী পরিষদে এক-তৃতীয়াংশ সদস্য মনোনয়ন দিতে পারেন। তবে তা হতে হবে নির্বাচিত সদস্যদের পরামর্শক্রমে। এতেও ক্ষুব্ধ হন নির্বাচিত সদস্যরা। তাদের বক্তব্য, সভাপতি কারও সঙ্গে পরামর্শ না করে একক সিদ্ধান্তে কার্যকরী পরিষদে সদস্য মনোনয়ন দেন।
গত ১৮ জানুয়ারি শিবিরের সম্মেলনের পরপরই সভাপতির অনুগতরা মামুনের পদত্যাগ দাবি করেন। মামুন ৩০ জানুয়ারি পদত্যাগ করলে জামায়াত নেতাদের মধ্যস্থতায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরোধ আপাত মীমাংসা হয়। কিন্তু সভাপতির অনুগতরা অভিযোগ করেন, মামুন শিবিরের আদর্শ মানছেন না। এ ঘটনায় মামুনের অনুগতরা পাল্টা সভাপতির পদত্যাগ দাবি করেন। কার্যকরী পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য সভাপতির বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহার করার অভিযোগ আনেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিবিরের সাবেক পাঁচ সভাপতির সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির তদন্তে সভাপতিকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। তদন্ত কমিটির এমন প্রতিবেদনে ক্ষুব্ধ মামুন ও তার অনুগতরা গত রোববার মাওলানা নিজামীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে নিজামী তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেন, রেজাউল করিম নির্দোষ এবং তিনিই সভাপতি পদে বহাল থাকবেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওইদিন রাতেই পদত্যাগ করেন মামুন। পরদিন একযোগে আরও ২৩ সদস্য পদত্যাগ করেন।
বিদ্রোহীদের যত অভিযোগ
পদত্যাগীদের অভিযোগ, সভাপতি রেজাউল করিম শিবিরের দলীয় তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। রেজাউল করিম বিবাহিত। তিনি সংসারের ব্যয় নির্বাহ করেন দলীয় তহবিলের টাকায়। সবশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের নৃশংসতাও মেনে নিতে পারেননি অনেকে। আরেকটি বড় অভিযোগ হলো, রাবির ঘটনার পর দলীয় নেতাকর্মীদের রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি সভাপতি। সবচেয়ে বড় অভিযোগ, শিবির তার ইসলামী আদর্শিক দলের চরিত্র হারিয়েছে। মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মতো রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। বিদ্রোহীদের সূত্রে জানা গেছে, তারা চাইলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তিতে সভাপতিকে অভিশংসন করতে পারতেন। কিন্তু শিবিরকে শুদ্ধ করতে, আদর্শ ফিরিয়ে আনতে, নিজেরাই পদত্যাগ করেছেন। যেন দেশবাসী শিবির ও জামায়াত নেতাদের অবক্ষয় সম্পর্কে জানতে পারেন।
কোন্দলের সূত্রপাত
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী জামায়াতের আমির এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই দলটিতে চরম বিরোধ দেখা দেয়। মুজাহিদকে কোনোভাবেই সেক্রেটারি জেনারেল মেনে নিতে পারেননি সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, মহানগর জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক হামিদুর রহমান আযাদ। নিজামীর ওপর ক্ষুব্ধ না হলেও দলে প্রভাব সৃষ্টি করতে গিয়ে অনেক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ায় মুজাহিদের ওপর সিনিয়র নেতাদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। আর নিজামীর সমর্থন পেয়েই মুজাহিদ দিনদিন বেপরোয়া হয়ে ওঠে বলে তারা মনে করতেন। এ বিষয়ে নিজামীর কাছে অভিযোগও করেন তারা। কিন্তু তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি।
সূত্রমতে, ছাত্রশিবিরের সম্মেলনের পর মুজাহিদের নির্দেশমতে রেজাউল করিম সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে শিশির মুহাম্মদ মুনিরকে সরিয়ে দেন। দায়িত্ব দেওয়া হয় তুলনামূলক তরুণ ডা. মামুনকে। এরপর শিবিরের একটি অংশ সভাপতির বিরুদ্ধে আত্মসাতের অভিযোগে লিফলেট বিতরণ করে। একইসঙ্গে শিবির সাধারণ সম্পাদককে পদত্যাগ করতে চাপ সৃষ্টি করেন তার সমর্থিত নেতাকর্মীরা। এ বিষয়ে জামায়াতের আমিরের কাছে অভিযোগ করে নতুন কমিটি দাবি করা হয়। কিন্তু এখানেও মুজাহিদ হস্তক্ষেপ করে নতুন কমিটি প্রয়োজন নেই বলে নিজামীকে বোঝাতে সমর্থ হন।
এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ জামায়াত নেতাদের পরামর্শে পদত্যাগ করেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। পদত্যাগের আগে জামায়াতের কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে মামুনসহ কয়েকজন বৈঠক করেছিলেন। এ বিষয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
শিবিরের গণপদত্যাগের ঘটনার অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিজামী জামায়াতের আমির ও মুজাহিদ সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ধর্মীয় এ দলটিতে কোন্দলের সৃষ্টি হয়। এরপর দলের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় নানা মতবিরোধ। আর সেই বিরোধেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ছাত্রশিবিরে। কেন্দ্রীয় নেতাদের ইন্ধন এবং শিবির সভাপতিবিরোধীরা এই বিদ্রোহ ঘটান। তবে পদত্যাগী নেতারা শিবিরের বিদ্রোহের জন্য জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে দায়ী করেন। মুজাহিদ শিবিরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করতেন। শিবির সভাপতির মাধ্যমে অনেক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতেন। ছাত্রশিবিরের অধিকাংশ নেতাকর্মী এখন রগ কাটা রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না। অনেকে অভিযোগ করেন, রাবির ঘটনাতেও মুজাহিদের ইন্ধন ছিল। রাবি সভাপতিও ব্যাপারটি জানতেন না। সেই ক্ষোভ থেকেই রাবি সভাপতিও গতকাল পদত্যাগ করেছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেনের বর্বর হত্যাকা ের পর রাজশাহীসহ সারাদেশে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চিরুনি অভিযান চালায়। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে অবস্থান নেয় সরকার। এরই মধ্যে শিবিরের প্রায় সাত শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। গ্রেফতার এড়াতে জামায়াত ও শিবিরের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতারাও গা ঢাকা দিয়েছেন।
শিবির সভাপতি যা বলেন
ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদকসহ কার্যকরী পরিষদের ২৪ সদস্যের পদত্যাগের একদিন পর শিবির সভাপতি মুহাম্মদ রেজাউল করিম দাবি করেন, শিবিরের সাধারণ সম্পাদক ডা. আবদুল্লা আল মামুন গত ৩০ জানুয়ারিই পদত্যাগ করেছেন। কার্যকরী পরিষদের যেসব সদস্য পদত্যাগ করেছেন তাদের অনেকেরই ছাত্রত্ব স্বাভাবিক নিয়মে শেষ হয়েছে। চলতি মাসে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল সে নির্বাচনের আগে তাদের স্বাভাবিক নিয়মেই সংগঠন থেকে বিদায় নিতে হতো। রেজাউল করিম দাবি করেন, স্বজনপ্রীতি করে নিজের অনুগত কাউকে কার্যকরী পরিষদে মনোনয়ন দেননি। বরং সংগঠনের কার্যক্রমকে স্বাভাবিক রাখার জন্যই এসব মনোনয়ন দেন। গতকাল সংবাদপত্র অফিসে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি এসব দাবি করেন।
রেজাউল করিম বিবৃতিতে বলেন, চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি সাধারণ সদস্যের ভোটে ২০১০ সালের জন্য সভাপতি নির্বাচিত হই। এরপর কার্যকরী পরিষদের সঙ্গে পরামর্শ করে সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল মনোনয়নের কাজ সম্পন্ন হয়। তারপর সব সদস্য ও সাথী শাখা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
গত ৩০ জানুয়ারি কার্যকরী পরিষদের সভায় রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারে যে অভিযোগ আনা হয় তা বিবৃতিতে উল্লেখ না করে তিনি বলেন, কার্যকরী পরিষদের সভায় উদ্ভূত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং সমাধানের জন্য ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হয়। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয় সংগঠনের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। বিবৃতিতে শিবির সভাপতি দাবি করেন, সাধারণ সম্পাদক ডা. মামুন গত ৩০ জানুয়ারি পদত্যাগ করলেও তার অনুরোধে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখেন। উল্লেখ্য, রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তদন্তে শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতিদের সমন্বয়ে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
বিবৃতিতে শিবির সভাপতি বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত সহিংসতার দায় শিবিরের ওপর চাপিয়ে সরকার চিরুনি অভিযানের নামে নির্যাতন শুরু করলে কার্যকরী পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে ২০০৯ সালের জন্য নির্বাচিত পরিষদই সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। বিবৃতিতে শিবির সভাপতি বলেন, দলীয় সংবিধান অনুযায়ী কার্যকরী পরিষদ গঠিত না হওয়ায় সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল মনোনয়ন, পরিকল্পনা গ্রহণ ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনায় সমস্যা দেখা দেয়। সংগঠনের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য ২০১০ কার্যকালের জন্য কার্যকরী পরিষদ গঠনের লক্ষ্যে গত ২১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। নির্বাচন চলাকালে ২২ তারিখ গভীর রাতে গণমাধ্যমের সংবাদে জানতে পারি সেক্রেটারি জেনারেলসহ ২৪ জন কার্যকরী পরিষদ সদস্য পদত্যাগ করেছেন।
শিবির সভাপতি বিবৃতিতে দাবি করেন, গত ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি ডা. মামুনের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। সেই সঙ্গে কার্যকরী পরিষদের নির্বাচনের কাজও শুরু করেন। তিনি বলেন, পরিষদের নির্বাচন চলাকালে বিদায়ী পরিষদের কোনো কার্যকারিতা থাকে না। ফলে পরিষদের সদস্য হিসেবে পদত্যাগেরও সুযোগ নেই। তাছাড়া কেন্দ্রীয় সভাপতির কাছে পদত্যাগপত্র পেশ না করে গণমাধ্যমে তা পরিবেশন করা দুর্ভাগ্যজনক, অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত ও অসাংবিধানিক।
শিবির সভাপতি দাবি করেন, ২৪ জন পদত্যাগ করেছেন এ সংবাদও সত্য নয়। কাউকে সম্বোধন না করে 'নিম্নোক্ত স্বাক্ষরকারী আমরা পরিষদ সদস্যরা সংগঠনের পরিষদ সদস্য থেকে স্ব-জ্ঞানে পদত্যাগ করছি' লিখে সাদা কাগজে ১৮ জন সদস্য সই করেছেন বলে শুনেছি। ১৮ জন সদস্যের মধ্যে ৯ জনের স্বাভাবিক ছাত্রজীবন শেষ হয়েছে বলেও শিবির সভাপতি বিবৃতিতে দাবি করেন।