সিলেট মহানগর ও জেলা নেতাদের গণপদত্যাগ!

জামায়াতে ইসলামীর আদর্শিক ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরে অভ্যন্তরীণ কোন্দল আবারও মাথাচাড়া দিয়েছে। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিমের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে সিলেট মহানগর ও জেলা কমিটির উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক নেতা ঈদুল ফিতরের আগে একযোগে পদত্যাগ করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরও কার্যত কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে নেই। গুরুত্বপূর্ণ দুটি শাখার নেতারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ। সিলেট মহানগর শাখার সভাপতি শাহরিয়ার আলম শিপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আনিসুর রহমান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মুহাম্মদ শামসুদ্দিন আহমেদ গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেছিলেন।
জানা গেছে, ঈদুল ফিতরের আগে সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীয় সভাপতির সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়ান শিবিরের সিলেট মহানগর শাখার সভাপতি শাহরিয়ার আলম শিপার। একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় সভাপতি শিপারকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহারের কথা জানিয়ে সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মুফিককে দায়িত্ব নিতে বলেন। কিন্তু মুফিক এ প্রক্রিয়ায় সভাপতির দায়িত্ব নিতে অনীহা প্রকাশ করেন।
এদিকে কেন্দ্রীয় সভাপতির এই পদক্ষেপকে অসাংগঠনিক আখ্যা দিয়ে শাহরিয়ার আলম শিপার দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেন। তাঁকে অনুসরণ করে মহানগর (উত্তর-দক্ষিণ) ও বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন জেলার সভাপতি-সেক্রেটারিসহ অধিকাংশ সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন। এ অবস্থায় শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির ও ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি অ্যাডভোকেট এহছানুল মাহবুব জুবায়েরের দ্বারস্থ হন। পরে তাঁর মধ্যস্থতায় পদত্যাগীদের নিবৃত্ত করে গত রবিবার বিশেষ সদস্য সম্মেলন আহ্বান করে ২০১০ সেশনের বাকি সময়ের জন্য শফিকুল ইসলাম মুফিককে সভাপতি ও মাহমুদুর রহমান দেলোয়ারকে সেক্রেটারির দায়িত্ব দেওয়া হয়। শিবির সভাপতি মুহাম্মদ রেজাউল করিম বিশেষ সদস্য সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল ডা. ফখরুদ্দিন মানিক। প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেন মহানগর জামায়াতের আমির এহছানুল মাহবুব জুবায়ের।
গত বছরের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলনে মুহাম্মদ রেজাউল করিম দ্বিতীয়বার সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর শিশির মোহাম্মদ মনির সেক্রেটারি জেনারেল পদ থেকে বাদ পড়লে শিবিরের একটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এর রেশ ধরে ওই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি শিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরীসহ ১৮ জন কেন্দ্রীয় পরিষদ (কাপ) সদস্য একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিয়ে একযোগে পদত্যাগ করেন। অনেকের ধারণা, বিক্ষুব্ধ ওই অংশটি পরদিন 'সেভ শিবির' শিরোনামে বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিবির সভাপতির বিরুদ্ধে সংগঠনের ঐতিহ্য ভেঙে বিয়ে করাসহ কিছু দুর্নীতি ও অনৈতিকতার প্রশ্ন তুলে ই-মেইল বার্তা পাঠায়।
কিন্তু পদত্যাগী নেতাদের অনেকে গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত কার্যকরী পরিষদের নির্বাচনে জয়ী হলে অভ্যন্তরীণ বিবাদের রেশ রয়েই যায়। কার্যকরী পরিষদের নির্বাচনে ৯ জন বিদ্রোহী নেতা পুনরায় জয়ী হন বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, এঁদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি মুহাম্মদ শামসুদ্দিন আহমেদ, তারেকুজ্জামান ও নাসির উদ্দিন মোল্লার নাম ছাড়া জুবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া, নজরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, জাকির হোসাইন, শাহরিয়ার আলম শিপার, ডা. শহিদুল্লাহ শরীফ ও আসাদ উদ্দিনের নাম প্রকাশ করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত ৩৩ সদস্যের মধ্যে ২৫ পরিষদ সদস্যের নাম প্রকাশ করা হয়।
এ বিষয়ে দৈনিক কালের কণ্ঠসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে জামায়াতে ইসলামী দলের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির অধ্যাপক এ কে এম নাজির আহমদকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তবে জামায়াতের আমিরের অনিচ্ছায় কমিটি তদন্ত শেষ করেনি। বিষয়টি জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যেও বিভাজন সৃষ্টি করে। তবে মহাজোট সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম শুরু করলে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়, বিদ্রোহীরাও চুপসে যান।
জানা গেছে, সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যে সমস্যা আছে এমন শাখাগুলোর নেতৃত্বে পরিবর্তন আনছেন কেন্দ্রীয় সভাপতি। ইতিমধ্যেই সংগঠনের ১১টি শাখায় উপনির্বাচন করা হয়েছে। শিবির সভাপতি ড. রেজাউল করিম ও সেক্রেটারি জেনারেল ডা. ফখরুদ্দিন মানিক দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফর করে নির্বাচন পরিচালনা করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিবির সভাপতি আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর চাংপাই চায়নিজ রেস্টুরেন্টে বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। তবে সংগঠনে নতুন করে জটিলতা দেখা দেওয়ায় অনুষ্ঠানটি স্থগিত করা হয়েছে।
সিলেটের ঘটনার বিষয়ে কথা বলার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেও শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সেক্রেটারি জেনারেলকে পাওয়া যায়নি। দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার একযোগে পদত্যাগের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করে বলেন, 'শাহরিয়ার আলম শিপারের ছাত্রত্ব শেষ, এ জন্য বাকি সময়ের জন্য বিশেষ সদস্য সম্মেলন করে শফিকুল ইসলাম মুফিককে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।'
যোগাযোগ করলে সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির এহছানুল মাহবুব জুবায়েরও এ ধরনের ঘটনা অস্বীকার করে প্রতিবেদককে বলেন, 'কমিটি এক বছরের জন্য নির্বাচিত হলেও ছাত্রত্ব শেষ হওয়াসহ নানা কারণে ষাণ্মাসিক পরিবর্তনও হয়। সার্বিক পরিস্থিতির কারণে এ পরিবর্তন করা হয়নি, এখন হয়েছে।'